ঢাকা,শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪

আঁধার মানিক বা কাঁনা রাজার সুড়ঙ্গঘিরে পর্যটনের অপার সম্ভাবনা

সোয়েব সাঈদ, রামু ::

কক্সবাজারের রামুতে আঁধার মানিক বা কাঁনা রাজার সুড়ঙ্গকে ঘিরে গড়ে উঠতে পারে পর্যটনের অপার সম্ভাবনা। সাড়ে তিনশ বছরের পুরনো এ সুড়ঙ্গ সংস্কার হলে হয়ে উঠবে দেশের অন্যতম দর্শনীয় স্থান। রামু উপজেলার কাউয়ারখোপ ইউনিয়নের উখিয়ারঘোনা নামক দূর্গম এলাকায় রয়েছে প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন এ আঁধার মানিক। যা স্থানীয়ভাবে কাঁনা রাজার সুড়ঙ্গ (গুহা) হিসেবে পরিচিত। কক্সবাজারের ইতিহাস গ্রন্থ ছাড়াও পাকিস্থান আমলে প্রকাশিত পাকিস্তান পর্যটন ডিপার্টম্যান্ট টুররিষ্ট গাইড এ রামুর এ আঁধার মানিক বা কাঁনা রাজার সুড়ঙ্গের কথা লিপিবদ্ধ ছিলো।

দীর্ঘদিন অযতœ-অবেহলায় পড়ে থাকা এ ঐতিহাসিক সুড়ঙ্গটি ফের উন্মোচন করেছেন রামুর একঝাঁক ছাত্র-যুবক। এদেরই একজন রামুর কাউয়ারখোপ ইউনিয়নের বাসিন্দা ছড়াকার কামাল হোসেন জানান, তারা সেই ছোটকাল থেকে এ সুড়ঙ্গটির কথা লোকমুখে শুনে আসছিলেন। পরে বিভিন্ন পুরনো এবং স্থানীয়ভাবে প্রকাশিত বইতেও সুড়ঙ্গটির তথ্য জানতে পারেন। কিন্তু অযতœ-অবহেলা ও প্রচারের অভাবে সুড়ঙ্গটি এলাকার অনেক লোকজনও দেখেনি।

স্থানীয় শিক্ষক তাজ উদ্দিন ও মোহাম্মদ আবদুল্লাহ জানান আরো জানান, বিষয়টি নিয়ে এলাকায় আলোচনার পর সম্প্রতি সুড়ঙ্গটি দেখতে যান অনেকে। কিন্তু সুড়ঙ্গের প্রবেশমুখটি তখন পাহাড়ের মাটি ও জঙ্গলে ঢাকা। নিজেরাই সেই মাটি ও জঙ্গল কেটে সুড়ঙ্গ যেন ফের আবিস্কার করলো সবাই। সুড়ঙ্গের ভিতরে গিয়ে অবাক হতে হয়ে সবাইকে। এ যেন জীবন্ত গুহা।

আঁধার মানিকের ইতিহাস : রামু উপজেলার কাউয়ারখোপ ইউনিয়নের উখিয়ারঘোনা এলাকার আঁধার মানিক স্থানীয়ভাবে কাঁনা রাজার সুড়ঙ্গ (গুহা) হিসেবে পরিচিত। ঐতিহাসিক সূত্রমতে এটিকে রাজা চিন পিয়ান বা কিংবেরিং এর উদ্ধাস্তু জীবনের শেষ সময়কালের আশ্রয়স্থল বা দূর্গ বলে ধারনা করা হত।

কথিত আছে বর্মী সেনা ও বর্মী অনুগত আরাকানিদের উপর অত্যাচার করার কারনে প্রতিপক্ষের সংঘবদ্ধ আক্রমনে পরাজিত হয়ে চিন পিয়ান বৃহত্তর চট্টগ্রামে পালিয়ে এসে আত্মগোপন করেন। তাকে গ্রেফতার করতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী তৎকালীন ৫ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষনা করেন। এ পরিস্থিতিতে আত্মরক্ষার জন্য চিন পিয়ান পুনরায় আরাকানের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। সেখানেও বর্মীদের পাল্টা প্রতিরোধের কারনে তিনি রামুর পাহাড়ি অঞ্চলে আশ্রয় নেন। এখানে থাকাকালীন নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য পাহাড়ের গভীরে খনন করা হয় এই গোপন সুড়ঙ্গ বা দূর্গ।

বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী তানভীর সরওয়ার রানা জানিয়েছেন, এলাকার একঝাঁক ছাত্র-যুবক সম্প্রতি কাউয়ারখোপ হাকিম-রকিমা উচ্চ বিদ্যালয়ের রজত জয়ন্তী স্মরনিকা’র প্রচ্ছদের জন্য আমাকে আঁধার মানিকের ছবি এঁকে দিতে বলেন। এসময় আমি ছবি আকাঁর উদ্দেশ্যে গুহা’টি সরেজমিন দেখার আগ্রহ প্রকাশ করি। সে অনুযায়ি গত ২৩ মার্চ দূর্গম ওই এলাকায় গিয়ে আঁধার মানিক বা কাঁনা রাজার সুড়ঙ্গ দেখে অন্যান্যদের মত আমি বিষ্মিত হই। ওই দিনই গুহাটি আমাদেন নতুন করে খোঁজে নিতে হয়েছে।

তিনি আরো জানান, এটি কেবল একটি সুড়ঙ্গ নয়। এটি একটি হাজার বছরের ইতিহাস। ঐতিহাসিক পটভূমি ও লোকমুখে জানা তথ্যমতে এটি অনেক দীর্ঘ সুড়ঙ্গ। এটি আর্ন্তজাতিক রাজনীতির অংশ বিশেষ বা কোন প্রতাপশালী রাজার নিরাপত্তার জন্য তৈরী করা সেনা ক্যাম্পও হতে পারে। এ সুড়ঙ্গটিকে বিশে^ প্রতিষ্ঠিত করতে তিনি সব প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবেন বলে জানান। এজন্য তিনি দেশের প্রতœতত্ববিদ, প্রশাসনিক ব্যক্তিবর্গ, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও এলাকার সর্বস্তুরের জনতার সহযোগিতা কামনা করেন।

কাউয়ারখোপ ইউনিয়নের উখিয়ারঘোনা গ্রামের বাসিন্দা কক্সবাজার জেলা পরিষদের সদস্য শামসুল আলম জানিয়েছেন, তাঁর গ্রাম থেকে একটু দূরেই এ আঁধার মানিক বা কাঁনা রাজার সুড়ঙ্গ। ছোট বেলায় তিনি কয়েকবার স্থানীয়দের সাথে ওই সড়ঙ্গে প্রবেশ করেছেন। তিনি সেখানে প্রায় ১০০ ফুট ভিতরে গিয়েছিলেন। সেই সুড়ঙ্গের ভিতরে একটি রঙ্গশালা বা মঞ্চ রয়েছে। যাকে অনেকে বিশ্রামাগারও বলে। আবার সেই সুড়ঙ্গের ভিতরে কিছুদূর গেলেই দেখা মিলত ৩টি সুড়ঙ্গ পথের মোহনা। তাঁর ধারনা এ সুড়ঙ্গ দিয়ে প্রবেশ করে কয়েকটি সুড়ঙ্গ দিয়ে বের হওয়ার পথ ছিলো। শামসুল আলম আরো জানান, একসময় এখানে চৈত্র সংক্রান্তি উৎসব চলাকালে মায়ানমার সহ আশপাশের রাখাইন ও বৌদ্ধ নারী পুরুষ এ সুড়ঙ্গ দেখতে আসতো।

শামসুল আলমের সাথে সহমত জানিয়েছেন, উখিয়ারঘোনা গ্রামের অমিয় বড়–য়ার স্ত্রী বানু বালা বড়–য়া। ৭০ বছর বয়সী এ নারী জানিয়েছেন, শিশু বয়সে তিনি এখানে অনেকবার গিয়েছিলেন। এখানে অনেকে আসতো মূল্যবান সম্পদের খোঁজে। এখনো এখানে অনেক মূল্যবান সম্পদ থাকতে পারে বলে ধারনা করেছেন তিনি।

স্থানীয় ছাত্রনেতা মোহাম্মদ নোমান জানান, গত ২৩ মার্চ (শুক্রবার) ছিলো আঁধার মানিক বা কাঁনা রাজার সুড়ঙ্গ নতুন করে আবিস্কারের দিন। ইতিহাস-ঐতিহ্যের সন্ধানে সেদিন সেখানে স্থানীয় ছাত্র-তরুন-যুবকদের সাথে গিয়েছিলেন, রামুর চিত্রশিল্পী, সংবাদকর্মীসহ সৃষ্টিশীল অনেক ব্যক্তিবর্গ।

ওইদিন (২৩ মার্চ) সকালে আঁধার মানিক বা কাঁনা রাজার সুড়ঙ্গ মাটি ও জঙ্গল কেটে উন্মোচনের পর সড়ঙ্গের সম্মুখে সবুজ প্রান্তরে চলে প্রাণবন্ত আড্ডা। এতে রামুর পর্যটন শিল্প বিকাশে আঁধার মানিক বা কাঁনা রাজার সুড়ঙ্গকে বিকশিত করতে করণীয় নিয়ে কথা বলেন, বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী তানভীর সরওয়ার রানা। আঁধার মানিক এর ঐতিহাসিক পটভুমি পাঠ করেন, ছড়াকার কামাল হোসেন। আলোচনায় অংশ নেন, সাংবাদিক সোয়েব সাঈদ ও আবুল কাসেম সাগর। সুড়ঙ্গ নতুনভাবে উন্মোচন ও আড্ডায় আরো অংশ নেন, শিক্ষক তাজ উদ্দিন, মোহাম্মদ আবদুল্লাহ ও আবুল কালাম আবু, নজরুল ইসলাম খোকন, সুলতান আহমদ, ছাত্রনেতা মোহাম্মদ নোমান, নুওয়াইছির আরাফাত সোহেল, শাহীন আলম, জসিম উদ্দিন, আবদুর রহিম, আবুল কালাম, দেলোয়ার হোসাইন সাঈদী, স্থানীয় বাসিন্দা তাতু বড়–য়া, ফয়সাল, ওবাইদুল হক প্রমূখ।

স্থানীয়দের দাবি, রামুর এ ঐতিহাসিক প্রতœতত্ব নিদর্শন সংস্কার করা হলে বাড়বে পর্যটনের সম্ভাবনা। দেশী-বিদেশী পর্যটকদের কাছে অন্যতম দর্শনীয় স্থান হতে পারে এটি।

রামু উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. শাজাহান আলি জানিয়েছেন, রামুর আঁধার মানিক বা কাঁনা রাজার সুড়ঙ্গ অনেক পুরনো ঐতিহাসিক নিদর্শন। প্রতœতত্ব নিদর্শন হিসেবে সংরক্ষণ ও পর্যটন শিল্প বিকাশের লক্ষ্যে এ সুড়ঙ্গ সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হবে।

পাঠকের মতামত: